শুভ্র মজুমদার,টাঙ্গাইল প্রতিনিধি:
টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার এক অজ্ঞাতনামা গ্রামে ঘটেছে এক হৃদয়বিদারক কাহিনী। ফুলকি মধ্যপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম ওরফে খসরু, দেশের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু, তার শেষ জীবন যেন এক নিরব কান্নায় আচ্ছন্ন।
২৫ বছর আগে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন, আর এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার আপন ছোট ভাই নবাব আলী কৌশলে তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আত্মসাৎ করে আসছেন।
এই ঘটনা কেবলমাত্র একটি প্রতারণার নয়, বরং এক মানবিকতার চরম পরাজয়ের গল্প। খোরশেদ আলম যখন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে নিজের জীবনযুদ্ধের সাথে লড়ছিলেন, তখন তিনি তার ছোট ভাই নবাব আলীর হাতে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন।
ভাইয়ের প্রতি এই নির্ভরতা, বিশ্বাসের যে বন্ধন, সেটাই হয়ে উঠেছিল তার প্রতারণার সূচনা।
নবাব আলী নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বড় ভাইয়ের মুক্তিযোদ্ধা কার্ডে নিজের ছবি লাগিয়ে, নিজেকে খোরশেদ আলম হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিয়মিতভাবে ভাতা তুলতে থাকেন। দীর্ঘদিন এই প্রতারণার খবর ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু যখন এই ঘটনা ফাঁস হয়, তখন গ্রামবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করে। তারা বিস্মিত যে, এমন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি নিজের জীবনের সেরা দিনগুলো দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, তার শেষ জীবন এমন প্রতারণার শিকার হয়ে কাটাতে হবে।
খোরশেদ আলমের ছেলে মান্নান মিয়া ২০১৮ সালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এই প্রতারণার বিষয়ে অভিযোগ করেন। তৎকালীন সময়ে এক বছরের জন্য ভাতা স্থগিত করা হলেও, অজানা কারণে পরে আবার চালু হয়। অবশেষে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে, খোরশেদ আলম নিজেই টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বাসাইল আমলি আদালতে মামলা করতে বাধ্য হন।
এই ঘটনা কেবল একটি পরিবারের ভাঙনের গল্প নয়, বরং এটি সমাজের মানবিক মূল্যবোধের এক চরম পরীক্ষা। একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, তাকে এমন করুণ অবস্থায় দেখতে পেয়ে এলাকার মানুষ শোকাহত। তারা দ্রুত সঠিক তদন্ত এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক আতাউল গনি এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মাদ মোশারফ হোসেন খান বিষয়টি নিয়ে সুন্দর একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন। এছাড়া, উপজেলা মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার নূরুল ইসলাম এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান শামছুর রহমান খান বিজু প্রতারণার এই ঘটনাটি সত্যতা স্বীকার করে প্রত্যায়নপত্র দিয়েছেন। একটি সূত্র জানায়, উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কিছু কর্মী এই প্রতারণার পিছনে থেকে সহযোগিতা করেছে।
একটি দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য লড়েছেন, তাকে যদি শেষ জীবনে এমন প্রতারণার শিকার হতে হয়, তবে আমাদের সমাজের মানবিক মূল্যবোধের অবস্থান কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এখনই। আমরা আশা করি, সমাজের সকল স্তরের মানুষ এবং কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই প্রতারণার অবসান ঘটাবেন।
সমাজের এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে আমাদের সকলের একসঙ্গে রুখে দাঁড়ানো উচিত। কারণ, একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের চূড়ান্ত সম্মান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।